ফিজিতে এসেছি ১৯৯৬ সালের মে’র শেষের দিকে। কেন জানিনা প্রথম থেকেই ফিজি আমাকে খুব টানতো। আজ তো ৮ বছরের বেশি হল আছি, একটুও পুরোনো মনে হয় না। তার কতগুলো কারণ আছে। প্রথমত এই ফিজিতে প্রায় বহুবছর আগে আসা ভারতীয়রা আছে, ফিজির জনসংখ্যার ৪৫% হল এই ভারতীয়। আর এই ফিজি হল শস্য-শ্যামলায় ভরা মনোরম দ্বীপপুঞ্জ। চারিদিকে প্রশান্ত মহাসাগর বেষ্টিত এই ফিজি। শান্ত পরিবেশ।আমার লেখায় সে ধার নেই, কোনো কবি যদি এখানে কিছুদিন থাকতেন এই পরিবেশে, হলফ করে বলতে পারি কবিতার দ্বারা তার ঝুলি ভরে উঠতো।
যে কারণে এই লেখা শুরু করেছি, সময়টা ছিল ১৯৯৭ সালের ৭ই মার্চ, শনিবার । শুনেছি কয়েক বছর অন্তর এখানে হ্যারিকেন (বিদ্ধংসী ঝড়) হয়। আর এখানকার সাধারণ মানুষের ধারণা যে বছরে আমের ফলন বেশি হয়, সেইবারে হ্যারিকেন নিশ্চিত। আর ১৯৯৬-এ নভেম্বর থেকে জানুয়ারীতে দুই বারে প্রচুর আমের ফলন হয়। এই ৭ই মার্চের দুই দিন আগে থেকেই সতর্কীকরন করা হচ্ছে রেডিও, খবরের কাগজ ও টিভিতে ফিজিবাসীকে, তারা যেন এই সময় বাড়ীর বাইরে বেশি না থাকে, অত্যন্ত্ জরুরি না হলে । আর এই সময়ে মৎস্যজীবিদেরও সতর্ক করে দেওয়া হল সমুদ্রে না যেতে। আর বলা হল যে যতটা পারে, অন্তত ২-৩ দিনের মতন খাবার যেন সংগ্রহ করে রাখে। মোমবাতি ও দেশলাই হাতের সামনে মজুত রাখে, আর পর্যাপ্ত পরিমানে জল সংরক্ষন করে রাখে। এই সতর্কীকরন ঘন্টায় ঘন্টায় রেডিওতে জানাতে লাগলো। ফিজির সংবাদ মাধ্যম মূলত রেডিও। কারণ ছোটো ছোটো আইল্যান্ডে টিভির রিসেপসন যায় না, আর কেনার ক্ষমতাও সকলের নেই, বেশির ভাগ মানুষই চাষ-আবাস করে দিন গুজরান করে।
যাই হোক ৫ তারিখ রাত্রি থেকে বৃষ্টি শুরু হল, আবহাওয়া কদিনআগে থেকেই তেমন সুবিধের যাচ্ছিল না । আবহাওয়াবিদ জানাচ্ছেন এই ঘুর্ণিঝড়ের সঠিক অবস্থান। যখনই কোনো হ্যারিকেন এসেছে, তাদের এক একটি নাম দেওয়া হয়েছে, এইবারের ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘গেভিন’। তা সকলেই তখন গেভিনের চিন্তায় আতঙ্কিত। আর এই ঝড়ের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য দরজা-জানলায় ঐ (দরজা-জানলা) সাইজের কাঠের দরজা থাকে, এই কাঠের দরজাগুলো এখানে বাড়ী তৈরী করার সময়েই করে রাখে প্রতিরক্ষা হিসাবে। দুদিন আগে থেকেই স্কুল, অফিস সব ছুটি দিয়ে দেওয়া হল যাতে সকলে সেইভাবে তৈরী হয় ক্ষয়-ক্ষতির হাত থেকে যতখানি নিজেদের বাঁচাতে পারে। সকলেই আগে সুপার মার্কেটগুলোতে ভীড় জমাতে লাগলো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর নেবার তাগিদে, এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তাদের দু-পয়সা লাভ করে নিল ক্রেতাদের কাছ থেকে। ৬ তারিখ সকালেই আমাদর বাড়ীর দরজা-জানলায় কাঠের দরজা এসে লাগিয়ে দিয়ে গেছে সৌমেনের (স্বামী) অফিসের লোকেরা। বাড়ীর ভেতরে প্রচন্ড গরমে এক মুহুর্ত থাকা যাচ্ছে না। বৃষ্টির প্রকোপ রাত থেকেই বাড়তে শুরু করলো। তার সঙ্গে দমকে দমকে ঝড়। আমার কাল বৈশাখীর অভিজ্ঞতা আছে, এর বেশি নয়। সারারাত চলল ঝড় ও বৃষ্টির তান্ডব।
পরের দিন সকালে ৭ তারিখ ঘুম থেকে উঠে দেখি আকাশ কেমন থমথমে ভাব। গুমোট হয়ে রয়েছে, বৃষ্টিও ধরেছে। সেদিন ছিল আমা শিবরাত্রি। ইচ্ছে ছিল মন্দিরে গিয়ে শিবের মাথায় জল দেওয়ার। উপায় না থাকাতে বাড়ীতেই পুজো সেরে নিলাম, আর দুবেলার রান্না করে রাখলাম, জানতাম যে কোনো মুহুর্তেই ইলেকট্রিসিটি চলে যাবে। দুপুর পর্য্যন্ত এই থমথমে ভাবটি ছিল। এরপরেই শুরু হতে লাগলো প্রচন্ড ঝড়ের সঙ্গে এলোমেলো বৃষ্টি, যেন সব উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে, আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে দিনের বেলাতেই, ঝড়ের গতি ক্রমশঃ বাড়তে শুরু করলো। এই গতিবেগ তখন ১২০-১৩০ কিমি পার ঘন্টা। মনে হচ্ছে যেন এই বাড়ী-ঘর উড়িয়ে নিয়ে যাবে, এদিকে পাওয়ার চলে গিয়ে সব অন্ধকার, খানিকটা পরে জলও চলে গেল। আমরা চারজনে (ছেলে ও মেয়ে সহ) তখন মেন দরজার সামনে বসে আছি, কারণ ঐ দরজাতে কাঠের প্রোটেকসন লাগানো হয়নি। মাঝে মাঝেই বিকট আওয়াজে কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, এই হ্যারিকেন ঝড়ের তান্ডব চলল প্রায় রাত ১০-১১টা পর্য্যন্ত। আমরা মোমবাতির আলোয় কোনোরকমে খাওয়া সাঙ্গ করে ঘুমোনোর চেষ্টা করতে লাগলাম, মোম ও জয় (কন্যা-পুত্র) দুজনেই ঘাবড়ে গিয়েছে, আমরা ভয় পেলেও ওদের সাহস যোগাচ্ছি যতটা পারি। একসময় থামল ঝড়, কিন্তু বৃষ্টি তখনও অঝোর ধারায় হয়ে চলেছে।
গরমে এবং মশার উপদ্রবে ঘুম হল না তেমন, ভোর হতেই মেন দরজা সামান্য খুলে দেখি আকাশ শান্ত। তবে সূর্য্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। প্রাতরাশ করার পরে সৌমেন বললো ‘চলো, একটু বাইরে গিয়ে দেখে আসি শহরের অবস্থা’। গাড়ী বার করে তো বেরোনো হল, একটু যেতেই দেখা গেল রাস্তার ধারে বড় বড় গাছ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। দু-একটি বাড়ীর ছাদের চালা উড়ে রাস্তায় পড়েছে, আমাদের সামনের বন্ধুর বাড়ীতেও ছাদের চালা উড়ে যাওয়াতে ওরা সকলে আমাদের বাড়ীতেই উঠেছিল। মনে হচ্ছে যেন সারা শহরটা( লাউটোকা) মৃত শহর। আস্তে আস্তে সিটি কাউন্সিলের লোকেরা বড় বড় গাছ সরিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলো। প্রায় দুদিন লাগলো আবার শহর চাঙ্গা হতে, আলো এলো, জল এলো। অফিস-কাছারি, স্কুল সব শুরু হল, তবে ক্ষয়-ক্ষতি কত হল তার কোনো হিসাব নেই। প্রচুর গরীব মানুষই তাদের ঘর-বাড়ী হারিয়ে পথে বসল। ফিজি সরকার যতটা পারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো, এছাড়া রেডক্রস, রামকৃষ্ণ মিশনও প্রচুর সাহায্য করেছিলো। আশেপাশের দেশগুলি থেকেও সাহায্য এসেছিল। এইভাবে একটি সাংঘাতিক ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছিলাম, যার নাম ‘গেভিন’।
ছবি সৌজন্য: ইন্টারনেট
লেখিকা : শুচিস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১১ই জুলাই , ২০০৮
লাউটোকা(ফিজি)
Friday, August 1, 2008
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
3 comments:
Ekta porishkar chhobi chhokher shamne bheshe uthlo tomar bornonae.
Shraddha
erokom obosthate na porle bodhoy onubhob kora mushkil je ki utkontha te jete pare ak akta minute.tumi khub sundor bhabe ei utkontha gulo bornona korecho.
tomar songe amio jeno oi dine harie gechhilam kichhukhhoner jonya lekha porte porte.
Post a Comment