Wednesday, August 13, 2008

প্রসঙ্গ : পরমানু চুক্তি


প্যারিসের মাটিতে বসে আজ যখন পরমানু চুক্তি নিয়ে লিখতে বসেছি তখন দিল্লীর রাজনীতি ভীষণ ভাবে উত্তাল। কিন্তু রাজনীতি আমার আলোচনার বিষয় বস্তু নয়। আমার আলোচনার বিষয় বস্তু হল 'ইন্দো আমেরিকা ১২৩ চুক্তি'। আমি আজ শুধু এই পরমানু চুক্তি নিয়েই আলোচনা করব। এই চুক্তি নিয়ে সাধারন মানুষের মধ্যেও ধন্ধের শেষ নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই। কারন এই চুক্তি বোঝার জন্যে যে টেকনিকাল জ্ঞান থাকা দরকার আমাদের মত সাধারন মানুষের তা নেই। কিন্তু যে চুক্তি নিয়ে সরকারের এই টালমাটাল অবস্থা সেই চুক্তি সম্পর্কে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা ধারনা থাকা ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পরে। আজ হাতের সামনে ইন্টারনেট এসে যাওয়ায় তথ্য পাওয়ার সুযোগও আছে প্রচুর। তাই এই লেখার মূল বিষয় পরমানু চুক্তিটিকে আর একটু বোঝার চেষ্টা করা। আমাদের নন্ টেকনিকাল জ্ঞানকে পাথেয় করেই।

বর্তমান এই চুক্তিটিকে বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে এর ইতিহাস। কিভাবে এবং কোন পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক চুক্তি ও সংস্থা। আমি সেই চুক্তি গুলোকে নিয়েই লেখার চেষ্টা করব।

পরমানু গবেষনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হল পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা। পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করা হয় মূলতঃ পরমানু অস্ত্রের ক্ষমতা যাচাই করার জন্যে। প্রথম পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করা হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ১৬ই জুলাই। বলাই বাহুল্য প্রথম পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করেছিল আমেরিকা। কিন্তু তারপর থেকে পাঁচটি দেশ (আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন) ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ টি পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করে এসেছে। কিন্তু এরপরেই বিশ্বের বাকি সমস্ত দেশ আস্তে আস্তে সোচ্চার হয় এই পরীক্ষা গুলোকে বন্ধ করার বিরূদ্ধে। তার কারন, এই পরীক্ষাগুলোর ফলে অনেক সময়েই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ পরিবেশে ছড়িয়ে পরার ভয় থাকে। ১৯৫৪ সালে ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহরুও এই অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করার স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি পেশ করেন।

অবশেষে অনেক প্রতিবাদ ও আলোচনার পরে একটা চুক্তি হয়। তাতে বলা হয় যারা এই চুক্তিতে সই করবে সেই সমস্ত দেশ খোলা জায়গায়, মহাকাশে এবং সমুদ্রের তলায় পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করতে পারবে না। ১৯৬৩ সালের এই চুক্তিটি ‘পারশিয়াল টেষ্ট ব্যান ট্রিটী’ বা ‘পি টি বি টি’ নামে পরিচিতি পায়। মানে চাইলে কোন দেশ মাটির তলায় পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করতে পারে। এই চুক্তিতে সই করে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে ফ্রান্স এবং চীন এই চুক্তি তে সই করে না। পরবর্তী কালে অবশ্য এই চুক্তির ই একটি বর্ধিত রুপ দেওয়া হয়, ১৯৯৬ সালে। যেখানে কোনরকম পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করাই নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখা হয়। চুক্তি টি কে বলা হয় ‘কম্প্রিহেনসিভ টেষ্ট ব্যান ট্রিটী’ বা ‘সি টি বি টি’ ।

লক্ষ্যনীয় যে, এই দুই চুক্তিতেই কোন দেশকে এমন বলা হয়নি যে তাদের পরমানু অস্ত্র সংক্রান্ত গবেষনা বন্ধ করে দিতে হবে। তারা শুধু পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু শুধু পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করলেই পরমানু অস্ত্র প্রসার রোধ করা সম্ভব ছিল না। তাই পরমানু অস্ত্র প্রসার রোধ করতে ১৯৬৮ সালে আর একটি চুক্তি র কথা বলা হয়। এর নাম দেওয়া হয় ‘নিউক্লিয়ার নন প্রলিফারেশন ট্রিটী’ বা ‘এন এন পি টি’ বা আরও সংক্ষেপে ‘এন পি টি’। এই চুক্তির মূল বিষয় হল বিশ্বের পাঁচটি দেশ আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন কে পরমানু শক্তিধর দেশ বলে মেনে নেওয়া হবে। এই পাঁচটি দেশ এই চুক্তিতে সই না করা অন্য কোন দেশ কে পারমানবিক প্রযুক্তি বা জ্বালানি সরাবরাহ করবে না। যে সমস্ত দেশ এই চুক্তিতে সই করবে তাদের মেনে নিতে হবে, তারা কোনভাবেই পরমানু অস্ত্র সংক্রান্ত কোনও গবেষনা করবে না। পরিবর্তে তারা পারমানবিক প্রযুক্তি বা জ্বালানি পাবে শান্তিপূর্ন পারমানবিক শক্তি (পারমানবিক বিদ্যুৎ ) উৎপন্ন করার জন্যে। কিন্তু এই সমস্ত দেশ গুলোকে নিজেদের পারমানবিক চুল্লী গুলি ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সী’ বা ‘আই এ ই এ’ র তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। যাতে ‘আই এ ই এ’ র দল দরকার হলে পরীক্ষা করতে পারে এই পারমানবিক চুল্লী গুলি শুধুই পারমানবিক বিদ্যুৎ তৈরির কাজে ব্যবহার হচ্ছে, না পরমানু অস্ত্রের জন্যে ফিসাইল মেটেরিয়াল তৈরি করা হচ্ছে। প্রসঙ্গতঃ ‘আই এ ই এ’ রাষ্ট্রসংঘের ছত্রছায়ায় কাজ করে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই ‘এন পি টি’ চুক্তিতে কোথাও এই কথা বলা নেই যে সমস্ত পারমানবিক শক্তিধর দেশগুলিকে নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে তাদের সমস্ত পারমানবিক অস্ত্রসম্ভার নষ্ট করে ফেলতে হবে। তার অর্থ এই যে, পারমানবিক শক্তিধর দেশগুলো একদিকে তাদের অস্ত্রসম্ভার রেখে দেবে, আবার অন্যদিকে, অন্য কোনো দেশকে নতুন করে পারমানবিক অস্ত্র বানাতে দেবে না। (এই প্রসঙ্গে একটি দেশের নাম এখানে উল্লেখ করতেই হয়। দক্ষিন আফ্রিকা ই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা নিজেরা পারমানবিক অস্ত্র তৈরী করেও নিজেরাই তা নষ্ট করে ফেলেছে।) চুক্তির এই খামতির কথা ভারত সহ আরও কিছু দেশ বারবার বলে এসেছে। তাই ভারতের পক্ষে এই চুক্তি সই করা সম্ভব হয় নি। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারত প্রথম পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করে ১৯৭৪ সালে। পরে আবার দ্বিতীয় পরীক্ষা করে ১৯৯৮ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন। ভারতের দ্বিতীয় পরীক্ষার পরে পরেই পাকিস্তান তাদের পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করে। এরপরে ২০০৬ সালে উত্তর কোরিয়াও সেরে ফেলে তাদের পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা। সেই অর্থে পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা না করলেও ধরে নেওয়া হয় ইস্রায়েলের কাছেও পরমানু অস্ত্র আছে। ফলে ‘এন পি টি’ তে স্বীকৃত পাঁচ পরমানু দেশ ছাড়াও এই মুহুর্তে ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া আর ইস্রায়েল এখন পরমানু শক্তি সম্পন্ন দেশ। এর মধ্যে ভারতই প্রথম ঘোষনা করে যে তারা পারমানবিক অস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত না হলে কখনই পরমানু অস্ত্র ব্যবহার করবে না। এর মধ্যে উত্তর কোরিয়া একসময় ‘এন পি টি’ তে সই করেও পরে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে। পাকিস্তানি বিজ্ঞানী এ কিউ খান পরমানু প্রযুক্তি অন্য দেশে পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েন। আর ইস্রায়েল এখনও পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা না করায় অনেক বিশেষজ্ঞই নিশ্চিত নন তাদের সত্যিকারের ক্ষমতা কতদূর। এইরকম অবস্থায় আমেরিকা সহ ‘এন পি টি’ স্বীকৃত পাঁচ পরমানু শক্তিধর দেশ এখন ভারতকেই সবচেয়ে দায়িত্ববান পরমানু শক্তি সম্পন্ন দেশ বলে মনে করছে। তাই ভারত ‘এন পি টি’ তে সই না করলে প্রথমতঃ এই চুক্তির গুরুত্বই কমে যায়। আর দ্বিতীয়তঃ ভারতের পরমানু গবেষনার ওপরও কিছুটা নিয়ন্ত্রন রাখা যায়। ফলে ভারতকে যেনতেন প্রকারেণ ‘এন পি টি’ তে সই করাতে উঠে পড়ে লেগেছিল সমস্ত পারমানবিক শক্তিধর দেশ গুলি। কিন্তু ভারত পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দেয় এই চুক্তির দ্বিচারিতা না দূর করলে ভারতের পক্ষে এই চুক্তি সই করা সম্ভব নয়।

ভারতের আভ্যন্তরীন প্রেক্ষাপট বিচার করলে গত দশ বছরে ভারতের অর্থনীতি যেভাবে বেড়েছে তা ধরে রাখতে গেলে অন্যতম প্রয়োজনীয় হল 'বিদ্যুৎ'। ভারতে এখনও প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌছায়নি। ২০৩০ সাল অবধি বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমান হবে প্রায় দেড় লক্ষ মেগাওয়াট। ২০৫০ সাল অবধি এই ঘাটতির পরিমান বেড়ে দাড়াবে প্রায় চার লক্ষ মেগাওয়াট। কেমন করে আসবে বিদ্যুৎ, যখন তেল ভাঁড়ার প্রায় শূন্য। কয়লা যা আছে ২০৫০ সাল অবধি তা দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। অন্যান্য নন কনভেনশনাল শক্তি দিয়েও চাহিদার র সামান্য ভগ্নাংশ ও মেটানো সম্ভব নয়। পারমানবিক বিদ্যুৎ ছাড়া আর কোনও উপায় ভারতের কাছে নেই। কিন্তু পারমানবিক বিদ্যুৎ ও আমাদের সমগ্র চাহিদার প্রায় ৩-৪ শতাংশ ই বর্তমানে মেটাতে পারছে। কারন পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সমস্ত পারমানবিক চু্ল্লী গুলো ইউরেনিয়ামের অভাবে ধুঁকছে। নতুন চু্ল্লী বানানোর কথা থাকলেও কি দিয়ে চলবে সেগুলো ? এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভারত চিন্তা করতে শুরু করে ইউরেনিয়াম অন্য কোনো দেশ থেকে কিনে এনে আরও বেশী পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব কিনা।

এদিকে ভারতের প্রথম পরমানু অস্ত্র পরীক্ষার পরই তৈরী হয়েছে ‘নিউক্লিয়ার সাপ্লাই গ্রুপ’ বা ‘এন এস জি’। মূলতঃ ভারতের পরমানু অস্ত্র পরীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতেই তৈরী হয়েছিল এই সংস্থা। বলা হয়েছিল ভারত কে অন্য দেশ (কানাডা), যে পারমানবিক চুল্লী দিয়েছে শান্তিপূর্ন শক্তির প্রসারের জন্যে, ভারত তা ব্যবহার করেছে পারমানবিক অস্ত্র তৈরীর কাজে। এই রকম ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে না ঘটে, তা আটকানোর জন্যেই তৈরী হয় এই ‘এন এস জি’। যে সমস্ত দেশ, ইউরেনিয়াম অন্য কোনো দেশ কে বিক্রী করতে চায়, তাদের নিয়ে তৈরী করা হয় এই গ্রুপ। যে সমস্ত দেশ, ‘এন এস জি’ র সদস্য কোনো দেশ থেকে ইউরেনিয়াম কিনতে চায়, সেই সমস্ত দেশ কে তাদের পারমানবিক চুল্লী ‘আই এ ই এ’ র তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে।

তার মানে সোজা সরল ভাষায়:

১) এই মুহুর্তে ভারত যে অবস্থায় রয়েছে তাতে নিজেদের পারমানবিক গবেষণার জন্যেই ভারতের দরকার প্রচুর পরিমান ইউরেনিয়াম। বোঝাই যাচ্ছে যে সেক্ষেত্রে পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তা কতটা প্রয়োজনীয়।

২) ভারত কে ইউরেনিয়াম যদি কিনতেই হয় তবে সেটা অবশ্যই কিনতে হবে ‘এন এস জি’ র সদস্য এমন কোনও দেশ থেকে ।

৩) কিন্তু তাতে মুশকিল হল যে, ‘এন এস জি’ র সদস্য এমন দেশ থেকে ইউরেনিয়াম কিনতে হলে ভারতকেও সমস্ত পারমানবিক চুল্লী ‘আই এ ই এ’ র কাছে খুলে দিতে হবে। যা ভারত করতে দিতে পারে না, কারন প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তানের কাছে পরমানু অস্ত্র থাকার দরুন ভারতের কাছেও পারমানবিক অস্ত্র বানানোর জন্যে পর্যাপ্ত ফিসাইল মেটেরিয়াল থাকা আবশ্যিক, যা ‘আই এ ই এ’ কখনওই ভারতকে করতে দেবে না।

ঠিক এই সময়েই আসে আমেরিকা র সাথে একটা অন্য রকম চুক্তির সুযোগ। কেমন হয় যদি এমন একটা চুক্তি হয় যাতে ভারত আমেরিকা থেকে পাবে ইউরেনিয়াম বা অন্যান্য পারমানবিক সরঞ্জাম (ডুয়াল ইউস টেকনোলজি)। কিন্তু অধিকার থাকবে নিজস্ব ফিসাইল মেটেরিয়াল বানানোর। এই রকম একটি চুক্তিই এখন বর্তমান রাজনীতির মূল বিষয়বস্তু। চুক্তিটির নাম হল ইন্দো আমেরিকা ১২৩ চুক্তি। এতে বলা হল, ভারত তার ইচ্ছেমতো পারমানবিক চুল্লী গুলোকে সিভিলিয়ান এবং মিলিটারি, এই হিসেবে আলাদা করে দিক। সিভিলিয়ান পারমানবিক চুল্লী গুলোর জন্য ইউরেনিয়াম সরাবরাহ করবে আমেরিকা। সেই চুল্লীগুলো অব্শ্যই থাকবে ‘আই এ ই এ’ র তত্ত্বাবধানে। কিন্তু মিলিটারি পারমানবিক চুল্লীতে ভারত তার ইচ্ছেমতো ফিসাইল মেটেরিয়াল তৈরি করতে পারবে। বলাই বাহুল্য, মিলিটারি পারমানবিক চুল্লীর জন্য ইউরেনিয়াম ভারতকেই জোগাড় করতে হবে।

তাহলে ব্যাপারটা দাড়াল এই রকম যে ‘এন পি টি’ তে বা ‘সি টি বি টি’ তে সই না করেই ভারত পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইউরেনিয়াম পেতে পারে এই চুক্তির মাধ্যমে।

কিন্তু তাহলে কেন চুক্তির এত বিরোধীতা ?

তার একটা কারন হল, ভারতের সাথে এই চুক্তি করার আগে আমেরিকা তাদের দেশে একটা আইন বানিয়েছে, এই চুক্তিকে গ্রহনযোগ্য করে তোলার জন্য। প্রনয়ন কর্তা হেনরি হাইডের নাম অনুসারে এই আইনের নাম ‘হাইড অ্যাক্ট’। এই আইনের মূল বক্তব্য ভারত যদি পরমানু পরীক্ষা করে, তাহলে আমেরিকা ভারতকে আর কোনো পরমানু প্রযুক্তি বা জ্বালানি সরাবরাহ করবে না। এছাড়াও আছে আরও কিছু শর্ত, যেমন,পারমানবিক চুল্লী তে ব্যবহৃত জ্বালানি ভারত যথেচ্ছ ভাবে রি-প্রসেস করতে পারবে না। প্রসঙ্গতঃ ব্যবহৃত জ্বালানি থেকে রি-প্রসেস করে ফিসাইল মেটেরিয়াল (পরমানু অস্ত্রের জন্য ব্যবহারের উপযোগী) বের করে নেওয়া যায়।

কিন্তু তাহলে তো ভারতের প্রধান শর্ত ই পালিত হচ্ছে না। ওদের এই আইন অনুযায়ী ভারত পরমানু পরীক্ষা করার অধিকার হারাচ্ছে। তাহলে ‘এন পি টি’ তে বা ‘সি টি বি টি’ র সাথে কি তফাৎ রইল এই চুক্তির ?

আপাত দৃষ্টিতে এরকম মনে হলেও ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ এরকম নয়। কারন, ভারত ‘হাইড অ্যাক্ট’ মানতে বাধ্য নয়। ‘হাইড অ্যাক্ট’ একটি আমেরিকান আইন, যা মেনে চলার দায়িত্ব শুধু আমেরিকান সরকারের। ভারত শুধু ১২৩ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি মেনে চলার জন্য দায়বদ্ধ। যে কোনও সময় যে কোনও এক পক্ষ এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

কিন্তু প্রশ্ন হল আমেরিকা যদি সত্যিই জ্বালানি দেওয়া বন্ধ (সেটা যে কোনও কারণেই করতে পারে আমেরিকা) করে দেয়, তাহলে কি করবে ভারত?

তার জন্য অন্য রাস্তাও আছে। এই চুক্তি বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার আগে ভারতকে ‘আই এ ই এ’ র সাথে চুক্তি করতে হবে এবং তারপরে ‘এন এস জি’ র অনুমোদন নিতে হবে। এক্ষেত্রে এটা বলে নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন মনে করছি যে আমেরিকার সাথে এই ‘ইন্দো আমেরিকা ১২৩’ চুক্তি সম্পন্ন হলে ভারতকে ‘এন এস জি’ র অনুমোদন নেবার সময় শুধু মাত্র সেই সব পারমানবিক চুল্লী গুলোকেই ‘আই এ ই এ’ র কাছে খুলে দিতে হবে, যেই চুল্লী গুলো কে তারা ‘সিভিলিয়ন’ ঘোষনা করবে। যেটা ‘আই এ ই এ’ র সাথে চুক্তির সময়ই ঠিক করে নিতে পারে ভারত।

‘আই এ ই এ’ র সাথে চুক্তির সময় ভারত এমন শর্ত রাখতে পারে যাতে করে হঠাৎ করে অন্য দেশ জ্বালানি বন্ধ না করে দিতে পারে। অথবা এমন শর্ত রাখা যেতে পারে যে ভারত তার ইচ্ছে মতো জ্বালানি ভান্ডার তৈরি করে নিতে পারে, আগে থেকেই এমন বিপদের আশংকা করে, যাতে করে হঠাৎ জ্বালানি বন্ধ হয়ে গেলেও ভারতকে সমস্যায় পরতে না হয়। তাছাড়া একবার ‘এন এস জি’ র থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়ে গেলে অন্য কোনও দেশের কাছ থেকেও জ্বালানি বা প্রযুক্তি নেওয়ার ব্যাপারে কোনো বাধা থাকছে না। ফ্রান্স ও রাশিয়া ইতিমধ্যেই আগ্রহ দেখিয়েছে ভারতের সাথে চুক্তি করার ব্যাপারে। সুতরাং ১২৩ চুক্তির মতই জরুরি বিষয় ‘আই এ ই এ’ র সাথে ভারত কি শর্তে চুক্তি করছে সেইটা। ভারত সরকার ইতিমধ্যেই ‘আই এ ই এ’ র সাথে চুক্তির খসড়া প্রকাশ করেছে। তাতে উপরোক্ত শর্ত গুলিও আলোচনায় থাকছে। এই প্রসঙ্গে বলা ভাল, এই সব জটিল প্রশ্ন তখনই আসবে যখন ভারত পরমানু পরীক্ষা করতে চাইবে। বিশেষজ্ঞদের মতে অদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনা খুবই কম। এই মুহুর্তে স্বীকৃত পরমানু শক্তিধর দেশ গুলিও পরমানু পরীক্ষা একরকম বন্ধই রেখেছে, যদিও পরমানু অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ফিসাইল মেটেরিয়াল হয়ত বানিয়েই চলেছে। ভারতের মত দায়িত্ববান পরমানু শক্তিধর দেশও সেই পথেই হাঁটবে কিনা সে তো সময়ই বলবে।

পরিশেষে একনজরে দেখা যাক, এই চুক্তির ফলে ভারত কি কি পেতে চলেছে।

১) ভারত পেতে চলেছে, পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পরমানু জ্বালানি ও প্রযুক্তি। ‘এন পি টি’ তে বা ‘সি টি বি টি’ তে সই না করেই।

২) ভারতের অধিকার থাকছে পরমানু অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ফিসাইল মেটেরিয়াল বানানোর।

৩) ভারত আরও যা পাচ্ছে তা হল বকলমে পরমানু শক্তিধর দেশের স্বীকৃতি। ভারতকে গোটা বিশ্ব যে দায়িত্ববান পরমানু শক্তিধর দেশ বলে মনে করে তার প্রমান হল, শুধু ভারতের জন্যই এমন এক চুক্তি করা যা পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া বা ইস্রায়েলের মত পরমানু শক্তি সম্পন্ন দেশের পক্ষেও ঈর্ষনীয়।

৪) ভারত পরমানু পরীক্ষার অধিকারও হারাচ্ছে না। আস্থা ভোটের জবাবী ভাষনে প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহের কিছু উদ্ধৃতি এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। উনি বলেছেন,

“I confirm that there is nothing in these agreements which prevents us from further nuclear tests if warranted by our national security concerns. All that we are committed to is a voluntary moratorium on further testing. Thus the nuclear agreements will not in any way affect our strategic autonomy. The cooperation that the international community is now willing to extend to us for trade in nuclear materials, technologies and equipment for civilian use will be available to us without signing the NPT or the CTBT.”

লেখার শেষে কিছু স্বীকারোক্তি। আমি পরমানু বিশেষজ্ঞ নই, জানার তাগিদে ইন্টারনেট ঘেঁটে লেখার চেষ্টা করেছি। আমার husband (তিনি একজন নিউক্লিয়র সাইন্টিস্ট)র সাথে এই ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনা পরমানু চুক্তি বিষয়ে আমার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। তা সত্বেও এই লেখায় অনিচ্ছাকৃত কিছু ভুল থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট



সুপর্না মিত্র
২৪শে জুলাই
প্যারিস, ফ্রান্স।

Saturday, August 2, 2008

ডাইরির পাতা থেকে .........

গত কয়েকদিন ধরে সাধারনতঃ তাপমাত্রা ০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড’এর কম থাকছে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি’ও পড়ছে। একটা শিহরিত হবার মত ঘটনা চোখে পড়লো সংবাদপত্রে। ঘটনাটি ঘটেছে আমাদের এই ছোট্ট শহরের ২৫ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। মানুষের জীবনে কখন যে কী ঘটবে কেউ তা জানে না। বেশ লম্বা ছুটি ছিলো নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে, একটি জনপ্রিয় উৎসব উপলক্ষ্যে এ সময় উত্তর আমেরকার ছোট বড় সব জায়গার মানুষই মাতেন ছুটির আনন্দে।

বাবা,মা আর তাদের দুটি শিশুসন্তান আমেরিকার ক্যালিফোর্ণিয়া স্টেটের একটি বেশ জমজমাট শহর থেকে একটি বড় গাড়ীতে চড়ে ছুটি কাটাতে যাচ্ছিলো প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে একটি ছোট্ট সমুদ্রসৈকতে। যদিও প্রশান্ত মহাসাগরে প্রখর গ্রীষ্মেও শৈত্যপ্রবাহ হয়। ভয়ঙ্কর ঠান্ডা থাকে এই দিকে সমুদ্রের জল বছরের যেকোন সময়ে। আর কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে সি-বিচ। যে শহরে আমরা থাকি এই বিচ তার থেকে ঘন্টা দেড়েকের পথ। পুরো গতিপথেই সঙ্গে চলে দু একটি নদী। ‘রোগ’নদী তার’ই একটি। এই নদীটি গ্রীষ্মে খুবই মনোরম। এর দুপাশের পথ পাহাড়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য সমস্ত গ্রীষ্ম, শরতে প্রচুর পর্যটক আকর্ষণ করে। কিন্তু শীতে এর অন্য রূপ। সাধারনতঃ বেশীর ভাগ পথই বরফে ঢাকা আর বন্য সৌন্দর্য্য আরো বিপদজনক হয়ে ওঠে এ সময়ে, এই পথে। তাই সাধারনভাবে ও পথে শীতে কেউ যান না। ছোট্ট পরিবারটি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অরেগন স্টেটের ‘রোজবার্গ’ নামের একটি ছোট শহরের রেস্তোরায় রাত্রি সাড়ে আটটার সময় নৈশভোজন সারে। তারপরে একটি অদ্ভুত অভিযান। রোগনদীর ধারে সমুদ্রের কাছাকাছি যে বিলাশবহুল হোটেলে তাদের সেই রাত্রিটি কাটাবার কথা ছিলো-সেই হোটেলে তারা আর পৌঁছান নি ।

মাঝখানে ন’টা দিন কেটে গেছে বৃষ্টি, তুষারপাত আমাদের এই পাহাড়ঘেরা ছোট্ট শহরটাতে একটা ঘুম ঘুম ভাব এনে দিয়েছিলো। খবরের কাগজে এই খবরটা পড়ে শহরের ঘুম গেলো ভেঙে। ৩৪বছরের বাবা, ৩০বছরের মা, ৪বছর আর ৭ মাস বয়েসের দুটি শিশুকন্যা- তারা হারিয়ে গেছে আমাদেরই শহরের খুব কাছাকাছি জঙ্গলে, পাহাড়ে, বরফের রাজ্যে। এ পাহাড়ে জংলী জানোয়ারের’ও অভাব নেই। আছে কুগার(পুমা), ভাল্লুক- এ সবের মত হিংস্র প্রানী’ও। চারদিন চারটি দলের অক্লান্ত খোঁজাখুজির পরে পাওয়া গেলো মা আর তাদের সন্তানদের। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, শীতে, ক্লান্তিতে আর দুঃশ্চিন্তায় বিপন্ন, অসুস্থ । কিন্তু বাবা?

ন’দিন ক্রমাগত মা তার বাচ্চাদের বুকের দুধ পান করিয়েছেন। গাড়ীতে পেট্রোল ফুরিয়ে যাওয়াতে গাড়ীর হিটার আর চালানো সম্ভব হয়নি। তারা পুড়িয়েছেন গাড়ীর টায়ার, বাক্সবন্দী জামাকাপড় একটু উষ্ণতার জন্য। যখন বিকেল চারটের সময়ে শহরে নেমে আসে রাত্রি। সমস্তটা দিন দেখা পাওয়া যায় না সূর্য্যদেবের,শহরের মধ্যেই দিনের বেলাতে ঘন কুয়াশার জন্য দেখতে পাওয়া যায় না কিচ্ছু-তবে বরফে ঘেরা জঙ্গলে কি অবস্থার মধ্যে কাটিয়েছিলো এই পরিবার ওই সাতটি দিন!

।।২।।

সপ্তম দিনে বাবা জেমস্ কিম তার স্ত্রী ও সন্তানদের ছেড়ে ভোরবেলা দুটি লাইটার সঙ্গী করে বেড়িয়েছিলেন খাদ্য ও জলের খোঁজে। তার পরনে ছিলো জিনসের প্যান্ট,টেনিস শ্যু, সোয়েটার ও একটি জ্যাকেট। জেমস্ দু’দিন পরেও তার গাড়ীতে ফিরে আসতে পারেন নি। মা ও তার সন্তানদের নিয়ে আসা হয় আমাদেরই শহরে। কিন্তু কোথায় গেলেন জেমস্!!স্যান-ফ্রান্সিসকো’র CNET-এর সিনিয়র এডিটর কি তবে হারিয়ে গেলেন ‘ওয়াইল্ড অরেগনে’র বরফঘেরা পাহাড়ী জঙ্গল!

কোনদিন কি স্যাবিন আর পেনেলোপ তাদের বাবাকে ফিরে পাবে? মনের মধ্যে একটা কষ্ট জমাট বাঁধে এই পরিবারটির জন্য। সামনেই ক্রিসমাস। বাড়িতে বাড়িতে আলোর রোশনাই, ভালোমন্দ খাওয়া দাওয়া, উপহার আদান প্রদান। ওই শিশুদুটি কি এই সুন্দর সময়ে হারাবে তাদের বাবাকে!ঈশ্বর তো মঙ্গলময়, তিনি কি পারেন না ওদেরকে ফিরিয়ে দিতে ওদের সবচেয়ে দামী উপহার-ওদের বাবাকে।

দুদিন পরে উদ্ধারকারী দল জেমসের মৃতদেহ খুঁজে পান একটি বড় খালের নর্দমায়।প্রচন্ড তুষার ঝড়ে তার দেহটি এসে পড়েছে ওই নর্দমাতে। এই মর্মান্তিক ঘটনা কেনো ঘটলো! যে পথে এমন অশুভ নিয়তি ভেঙে দিতে পারে সোনার সংসার, কেড়ে নিতে পারে দুধের শিশুদের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তার হাত-সে পথ বন্ধ হয়ে যায় না কেনো?? বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশেও কেনো ঘটে এমন ঘটনা!!

জানি না পৃথিবীতে কত দেশে প্রতিদিন এভাবে কত না মানুষ হারিয়ে যান তাদের প্রিয়জনেদের কাছ থেকে তার হিসেব কেউ রাখে না । সবাই ধীরে ধীরে ভুলে যায় তাদের কথা। কিন্তু আজ এই ঘটনার পরে একটা উপলব্ধিই হচ্ছে; কোথায়, কখন, কিভাবে যে চলে যেতে হবে-তা আগে থেকে কেউ জানে না। একটু উষ্ণতার জন্য, সন্তানদের মুখে একটু খাবার তুলে দেবার জন্য স্যানফ্রান্সিসকো’র উচ্চপদস্থ কর্মীটিকেও দিয়ে দিতে হল নিজের জীবন। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, এরকম মৃত্যু তিনি যেনো আর কোনো জন্মদাতাকে না দেন ।।

ছবি সৌজন্য: ইন্টারনেট





লেখিকা : শ্রদ্ধা পত্রনবীশ
অরেগন, উত্তর আমেরিকা
(ডিসেম্বর,২০০৬)

Friday, August 1, 2008

দক্ষিণ প্যাসিফিকের দ্বীপ ফিজিতে দেখা হ্যারিকেন :

ফিজিতে এসেছি ১৯৯৬ সালের মে’র শেষের দিকে। কেন জানিনা প্রথম থেকেই ফিজি আমাকে খুব টানতো। আজ তো ৮ বছরের বেশি হল আছি, একটুও পুরোনো মনে হয় না। তার কতগুলো কারণ আছে। প্রথমত এই ফিজিতে প্রায় বহুবছর আগে আসা ভারতীয়রা আছে, ফিজির জনসংখ্যার ৪৫% হল এই ভারতীয়। আর এই ফিজি হল শস্য-শ্যামলায় ভরা মনোরম দ্বীপপুঞ্জ। চারিদিকে প্রশান্ত মহাসাগর বেষ্টিত এই ফিজি। শান্ত পরিবেশ।আমার লেখায় সে ধার নেই, কোনো কবি যদি এখানে কিছুদিন থাকতেন এই পরিবেশে, হলফ করে বলতে পারি কবিতার দ্বারা তার ঝুলি ভরে উঠতো।

যে কারণে এই লেখা শুরু করেছি, সময়টা ছিল ১৯৯৭ সালের ৭ই মার্চ, শনিবার । শুনেছি কয়েক বছর অন্তর এখানে হ্যারিকেন (বিদ্ধংসী ঝড়) হয়। আর এখানকার সাধারণ মানুষের ধারণা যে বছরে আমের ফলন বেশি হয়, সেইবারে হ্যারিকেন নিশ্চিত। আর ১৯৯৬-এ নভেম্বর থেকে জানুয়ারীতে দুই বারে প্রচুর আমের ফলন হয়। এই ৭ই মার্চের দুই দিন আগে থেকেই সতর্কীকরন করা হচ্ছে রেডিও, খবরের কাগজ ও টিভিতে ফিজিবাসীকে, তারা যেন এই সময় বাড়ীর বাইরে বেশি না থাকে, অত্যন্ত্ জরুরি না হলে । আর এই সময়ে মৎস্যজীবিদেরও সতর্ক করে দেওয়া হল সমুদ্রে না যেতে। আর বলা হল যে যতটা পারে, অন্তত ২-৩ দিনের মতন খাবার যেন সংগ্রহ করে রাখে। মোমবাতি ও দেশলাই হাতের সামনে মজুত রাখে, আর পর্যাপ্ত পরিমানে জল সংরক্ষন করে রাখে। এই সতর্কীকরন ঘন্টায় ঘন্টায় রেডিওতে জানাতে লাগলো। ফিজির সংবাদ মাধ্যম মূলত রেডিও। কারণ ছোটো ছোটো আইল্যান্ডে টিভির রিসেপসন যায় না, আর কেনার ক্ষমতাও সকলের নেই, বেশির ভাগ মানুষই চাষ-আবাস করে দিন গুজরান করে।

যাই হোক ৫ তারিখ রাত্রি থেকে বৃষ্টি শুরু হল, আবহাওয়া কদিনআগে থেকেই তেমন সুবিধের যাচ্ছিল না । আবহাওয়াবিদ জানাচ্ছেন এই ঘুর্ণিঝড়ের সঠিক অবস্থান। যখনই কোনো হ্যারিকেন এসেছে, তাদের এক একটি নাম দেওয়া হয়েছে, এইবারের ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘গেভিন’। তা সকলেই তখন গেভিনের চিন্তায় আতঙ্কিত। আর এই ঝড়ের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য দরজা-জানলায় ঐ (দরজা-জানলা) সাইজের কাঠের দরজা থাকে, এই কাঠের দরজাগুলো এখানে বাড়ী তৈরী করার সময়েই করে রাখে প্রতিরক্ষা হিসাবে। দুদিন আগে থেকেই স্কুল, অফিস সব ছুটি দিয়ে দেওয়া হল যাতে সকলে সেইভাবে তৈরী হয় ক্ষয়-ক্ষতির হাত থেকে যতখানি নিজেদের বাঁচাতে পারে। সকলেই আগে সুপার মার্কেটগুলোতে ভীড় জমাতে লাগলো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর নেবার তাগিদে, এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তাদের দু-পয়সা লাভ করে নিল ক্রেতাদের কাছ থেকে। ৬ তারিখ সকালেই আমাদর বাড়ীর দরজা-জানলায় কাঠের দরজা এসে লাগিয়ে দিয়ে গেছে সৌমেনের (স্বামী) অফিসের লোকেরা। বাড়ীর ভেতরে প্রচন্ড গরমে এক মুহুর্ত থাকা যাচ্ছে না। বৃষ্টির প্রকোপ রাত থেকেই বাড়তে শুরু করলো। তার সঙ্গে দমকে দমকে ঝড়। আমার কাল বৈশাখীর অভিজ্ঞতা আছে, এর বেশি নয়। সারারাত চলল ঝড় ও বৃষ্টির তান্ডব।

পরের দিন সকালে ৭ তারিখ ঘুম থেকে উঠে দেখি আকাশ কেমন থমথমে ভাব। গুমোট হয়ে রয়েছে, বৃষ্টিও ধরেছে। সেদিন ছিল আমা শিবরাত্রি। ইচ্ছে ছিল মন্দিরে গিয়ে শিবের মাথায় জল দেওয়ার। উপায় না থাকাতে বাড়ীতেই পুজো সেরে নিলাম, আর দুবেলার রান্না করে রাখলাম, জানতাম যে কোনো মুহুর্তেই ইলেকট্রিসিটি চলে যাবে। দুপুর পর্য্যন্ত এই থমথমে ভাবটি ছিল। এরপরেই শুরু হতে লাগলো প্রচন্ড ঝড়ের সঙ্গে এলোমেলো বৃষ্টি, যেন সব উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে, আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে দিনের বেলাতেই, ঝড়ের গতি ক্রমশঃ বাড়তে শুরু করলো। এই গতিবেগ তখন ১২০-১৩০ কিমি পার ঘন্টা। মনে হচ্ছে যেন এই বাড়ী-ঘর উড়িয়ে নিয়ে যাবে, এদিকে পাওয়ার চলে গিয়ে সব অন্ধকার, খানিকটা পরে জলও চলে গেল। আমরা চারজনে (ছেলে ও মেয়ে সহ) তখন মেন দরজার সামনে বসে আছি, কারণ ঐ দরজাতে কাঠের প্রোটেকসন লাগানো হয়নি। মাঝে মাঝেই বিকট আওয়াজে কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, এই হ্যারিকেন ঝড়ের তান্ডব চলল প্রায় রাত ১০-১১টা পর্য্যন্ত। আমরা মোমবাতির আলোয় কোনোরকমে খাওয়া সাঙ্গ করে ঘুমোনোর চেষ্টা করতে লাগলাম, মোম ও জয় (কন্যা-পুত্র) দুজনেই ঘাবড়ে গিয়েছে, আমরা ভয় পেলেও ওদের সাহস যোগাচ্ছি যতটা পারি। একসময় থামল ঝড়, কিন্তু বৃষ্টি তখনও অঝোর ধারায় হয়ে চলেছে।

গরমে এবং মশার উপদ্রবে ঘুম হল না তেমন, ভোর হতেই মেন দরজা সামান্য খুলে দেখি আকাশ শান্ত। তবে সূর্য্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। প্রাতরাশ করার পরে সৌমেন বললো ‘চলো, একটু বাইরে গিয়ে দেখে আসি শহরের অবস্থা’। গাড়ী বার করে তো বেরোনো হল, একটু যেতেই দেখা গেল রাস্তার ধারে বড় বড় গাছ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। দু-একটি বাড়ীর ছাদের চালা উড়ে রাস্তায় পড়েছে, আমাদের সামনের বন্ধুর বাড়ীতেও ছাদের চালা উড়ে যাওয়াতে ওরা সকলে আমাদের বাড়ীতেই উঠেছিল। মনে হচ্ছে যেন সারা শহরটা( লাউটোকা) মৃত শহর। আস্তে আস্তে সিটি কাউন্সিলের লোকেরা বড় বড় গাছ সরিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলো। প্রায় দুদিন লাগলো আবার শহর চাঙ্গা হতে, আলো এলো, জল এলো। অফিস-কাছারি, স্কুল সব শুরু হল, তবে ক্ষয়-ক্ষতি কত হল তার কোনো হিসাব নেই। প্রচুর গরীব মানুষই তাদের ঘর-বাড়ী হারিয়ে পথে বসল। ফিজি সরকার যতটা পারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো, এছাড়া রেডক্রস, রামকৃষ্ণ মিশনও প্রচুর সাহায্য করেছিলো। আশেপাশের দেশগুলি থেকেও সাহায্য এসেছিল। এইভাবে একটি সাংঘাতিক ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছিলাম, যার নাম ‘গেভিন’।

ছবি সৌজন্য: ইন্টারনেট



লেখিকা : শুচিস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
১১ই জুলাই , ২০০৮
লাউটোকা(ফিজি)

Thursday, July 31, 2008

তারকা যুদ্ধ- ‘আন্দাজ্ আপনা আপনা’.......!


সেই দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, রাজ কাপুর-দের জামানা থেকে চলে আসছে। ভারতীয়দের মজ্জায় মজ্জায় গেঁথে আছে এটা। আমরা কেউ বাম তো কেউ ডান, কেউ সুনীল তো কেউ কপিল, কেউ শচীন তো কেউ দ্রাবিড়, কেউ সৌরভ তো কেউ ধোনি, কেউ ‘ভেজ’ তো কেউ ‘ননভেজ’। এই উদাহরণের কোনো শেষ নেই..........।

আমাদের বলিউডে ‘তারকা যুদ্ধ’ কখন যেন মিডিয়ার মুখোরোচক গল্প, ভারতীয় রমনীদের ‘আহা’ ‘ঊহু’ ছাড়িয়ে তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়ে, আর শুধূ ঢুকেই পড়ে না, তাদের অমন সাধের তন-মন-এ গভীরভাবে রেখাপাত করে, আমরা কেউ টেরটিও পাই না! না, একটু বোধহয় ভুল বললাম, আজকাল ২৪ ঘন্টা ২৪ গন্ডা নিউজ-চ্যানেলের দৌলতে করিনা কাপুরের সাথে সেইফ আলি খানের মিষ্টিমধুর সম্পর্কের খবর সাহিদ কাপুরের চেয়ে আমাদের কানেই বোধহয় আগে এসে পৌঁছোয়!!

যশরাজ ফিল্মস্ শাহরুখ খানে মজে তো রামু (রাম গোপাল ভার্মা) এখন বচ্চনদের খাস দোস্ত। আর করণ জোহর তো আছেই; কফি খেয়ে, পেজ-থ্রি পার্টি বা নানা শো’স্ সামলে ২-১ বছর অন্তর একটা ছবি বানালে কিং খানকে লিড্ রোলটা দিতে ভোলে না। করণের ছবি যেমন টেলি-ক্যুইন একতা কাপুরের মতো ‘K’ দিয়ে শুরু হয়, তেমনি ‘রাজ’ অথবা ‘রাহুল’ এর রোলে কিং খানও বাধা থাকে।
কিছুদিন আগে খাস মুম্বাই শহরে এই তারকাদের দল বিভাজনটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বলিউডের ‘গ্র্যান্ড ওয়েডিং’ উপলক্ষে। হুমমম্, আমি আমাদের ‘মিস্ ওয়ার্ল্ড’ ও ‘জুনিয়ার বচ্চন’এর মেগা বিবাহোৎসবের কথাই বলছি। ‘কাভি খুশী কাভি গাম’-এর দিন চলে গেছে- বচ্চনদের এই খুশীর দিনে সামিল হতে পারেনি সিনেমাতে অমিতাভ-জয়া পুত্র শাহরুখ হৃতিক কেউই! শাহরুখ নয় ভারতীয় টেলিভিশনের ইতিহাসে জনপ্রিয়তম রিয়েলিটি গেম শো ‘কৌন বানেগা কৌড়পতি’ ছিনিয়ে নিয়ে মহাপাপ করে বচ্চনদের বিরাগভাজন হয়েছে, হৃতিকের দোষটা কি? কানাঘুষো শোনা যায় ‘ধুম টু’ তে সেই চুম্বন দৃশ্য কিছুতেই হজম করতে পারেনি বচ্চনরা। যাইহোক, পূজাপাঠ হোম যজ্ঞ সবই হল, ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসের এক দুপুরে ঘন্টা পাঁচেকের জন্য জুহু অঞ্চলের ট্রাফিকও বন্ধ হল; কিন্তু সেদিন ‘জলসা’ থেকে ‘প্রতিক্ষা’গামী বাসে দেখা গেল না আরও অনেকের মতো অভিষেকের ‘ক্লাস-মেট’ হৃতিক রোশনকেও! তবে এমন কোনো খবর নেই যে হৃতিক সেদিনই নাম লিখিয়েছে SRK শিবিরে। না, বিতর্ক থেকে শতহস্ত দূরে থাকতেই পছন্দ করেন হৃতিক।

অম্বানি-ভাইরা ভাগ হয়েছে। আজ যদিও কেন্দ্রে তারা ভাই-ভাই, তবু রাজনীতিতেও স্পষ্ট মেরুকরণ দুই শিবিরে। রাহুল-প্রিয়াঙ্কা গান্ধীরা IPL এর ম্যাচে চলে আসে শাহরুখের টিমকে চিয়ার করতে, তো অন্যদিকে অমর সিংহের বদান্যতায় ‘বহু’ ঐশ্বর্য-এর নামে উওরপ্রদেশের দৌলতপুরে স্কুল খুলতে চলেছেন শ্বশুড় অমিতাভ।

যাইহোক আবার বলিউডে ফিরে আসা যাক। পরিচালকদের মধ্যে রামু, রোহন সিপ্পি, সাদ আলি-রা জলসার দিকে ঝুঁকে থাকলেও কিং খান লবিও কমজোড় নয়। ফারহা, ফারহান, করণদের যাতায়াত লেগেই থাকে মান্নতে।যশরাজ ফিল্মস্ এর all time blockbuster এর তালিকায় অবশ্য ‘সিলসিলা’ ও আছে ‘DDLJ’ও আছে। তবে জুনিয়ার বচ্চন সেই হিট দিতে পারেনি, আর তাই জন্যেই হয়তো তাবড় বলিউডের নায়ক নায়িকারা এতো ‘টশন্’ দেখানো সত্ত্বেও box office এ ফি-শুক্রবার মুখ থুবড়ে পড়ে কোটি টাকার ছবি। ‘চাক দে ইন্ডিয়া’র পর খরা চলছে আন্ধেরির ঐ প্রোডাকশন হাউজেও।

কিছুক্ষণের জন্য বিগ বি কে সরিয়ে রাখা যাক। তাছাড়া এখন তারা সপরিবারে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বিজি। যদিও নিয়মিত Blogging করেন তিনি। Blogger.com এখন বলিউডের অনেক তারকারই বেশ প্রিয় ‘হবি’। এমনিতেই বলিউডের সিনিয়ার ও ক্লাসি অভিনেতারা বেছে বেছে ছবি করেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে হাজিরা বা এড ফিল্মের শ্যুটিং, আত্মীয় বন্ধুদের জন্য প্রচার-ট্রচার সেরেও হাতে সময় পেয়েই যান। তাই তো আমরা জানতে পারি খান্ডালাতে ফার্ম হাউজে কেয়ারটেকারের কুকুর ‘শাহরুখ’ এর সাথে আনন্দঘন মূহুর্ত অতিবাহিত করে কত রোমাঞ্চিত আমির- খুশীর সে মুহূর্ত ভাগ করে নিতে ভোলেনি তার প্রিয় ফ্যানদের সাথে তার নিজস্ব ব্লগে। ভাগ্যিস ঐ শিবির থেকে আবার কেউ ব্লগ লিখতে বসেনি!!

ময়দানে তিন নম্বর খানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছিল IPL এর সময় থেকেই। শাহরুখ-প্রীতি লড়াই যখন মিডিয়া জমিয়ে তুলতে ব্যর্থ (প্রীতি শাহরুখের সাথে টক্কর দেওয়ার চেয়েও বোধহয় যুবির প্রতি বেশী আগ্রহী ছিল!), তখন বাজারে এসেছে দু-দুটো নতুন টেলি শো। শাহরুখের ‘কেয়া আপ পাঁচভি পাস সে তেজ হ্যায়?’ আর সালমনের ‘দাস্ কা দম’।

করণ-অর্জুনের মধ্যে যা শুরু করে দিয়েছে বলিউডের শেষতম ‘star war’! এর আগে নানা জায়গায় নানা অপ্রিয় সত্য বলে নানা জনের অপ্রিয় হয়েছে কিং খান। সম্প্রতি ক্যাটরিনার বার্থ-ডে পার্টি দিয়েছিল সাল্লু মিঁয়া। সেখানে বাকি দুই খান সহ বলিউডের অনেক তারকা উপস্থিত ছিল। না, বচ্চনরা থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বিবেক ছিল বলেও কোনো খবর নেই। সেদিন পার্টিতে একটাই খবর ছিল শুধু। সমস্ত ‘প্যায়ার কা বন্ধন’ ছিন্ন করে সালমান নাকি হাত তুলে বসে কিং খানের ওপর! কার শো টা বেশী TRP পাচ্ছে এই নিয়ে শুরু হয়ে শাহরুখের সৌজন্যে তা বোধহয় গড়ায় সাল্লু মিঁয়ার পুরাতন প্রেম তথা প্রেমিকার দিকে। সেদিন ‘মিস্টার কুল’ এর ভূমিকায় দেখা যায় আমির খানকে। সামাল দেন আমির।

আবর সাগরে কত জল গড়িয়ে যায়। স্বপ্ন নগরীতে রোজ কত নতুন তারকার জন্ম হয়। সেলুলয়েডে নতুন রূপকথা তৈরী হয়। কিন্তু আজীবন কাল ধরে চলে আসা তারকা যুদ্ধ থামে না। শুধু আসল রঙ্গমঞ্চে কয়েক দশক পর পর বদলে যায় কলা-কুশলীরা । এখানে সবার ‘আন্দাজ্ আপনা আপনা’..................!!

ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট ও অর্পিতা





লেখিকা : মৌমিতা চৌধুরী
১০ই জুলাই, ২০০৮
মুম্বই, ইন্ডিয়া।