Wednesday, August 13, 2008

প্রসঙ্গ : পরমানু চুক্তি


প্যারিসের মাটিতে বসে আজ যখন পরমানু চুক্তি নিয়ে লিখতে বসেছি তখন দিল্লীর রাজনীতি ভীষণ ভাবে উত্তাল। কিন্তু রাজনীতি আমার আলোচনার বিষয় বস্তু নয়। আমার আলোচনার বিষয় বস্তু হল 'ইন্দো আমেরিকা ১২৩ চুক্তি'। আমি আজ শুধু এই পরমানু চুক্তি নিয়েই আলোচনা করব। এই চুক্তি নিয়ে সাধারন মানুষের মধ্যেও ধন্ধের শেষ নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই। কারন এই চুক্তি বোঝার জন্যে যে টেকনিকাল জ্ঞান থাকা দরকার আমাদের মত সাধারন মানুষের তা নেই। কিন্তু যে চুক্তি নিয়ে সরকারের এই টালমাটাল অবস্থা সেই চুক্তি সম্পর্কে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা ধারনা থাকা ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পরে। আজ হাতের সামনে ইন্টারনেট এসে যাওয়ায় তথ্য পাওয়ার সুযোগও আছে প্রচুর। তাই এই লেখার মূল বিষয় পরমানু চুক্তিটিকে আর একটু বোঝার চেষ্টা করা। আমাদের নন্ টেকনিকাল জ্ঞানকে পাথেয় করেই।

বর্তমান এই চুক্তিটিকে বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে এর ইতিহাস। কিভাবে এবং কোন পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক চুক্তি ও সংস্থা। আমি সেই চুক্তি গুলোকে নিয়েই লেখার চেষ্টা করব।

পরমানু গবেষনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হল পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা। পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করা হয় মূলতঃ পরমানু অস্ত্রের ক্ষমতা যাচাই করার জন্যে। প্রথম পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করা হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ১৬ই জুলাই। বলাই বাহুল্য প্রথম পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করেছিল আমেরিকা। কিন্তু তারপর থেকে পাঁচটি দেশ (আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন) ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ টি পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করে এসেছে। কিন্তু এরপরেই বিশ্বের বাকি সমস্ত দেশ আস্তে আস্তে সোচ্চার হয় এই পরীক্ষা গুলোকে বন্ধ করার বিরূদ্ধে। তার কারন, এই পরীক্ষাগুলোর ফলে অনেক সময়েই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ পরিবেশে ছড়িয়ে পরার ভয় থাকে। ১৯৫৪ সালে ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহরুও এই অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করার স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি পেশ করেন।

অবশেষে অনেক প্রতিবাদ ও আলোচনার পরে একটা চুক্তি হয়। তাতে বলা হয় যারা এই চুক্তিতে সই করবে সেই সমস্ত দেশ খোলা জায়গায়, মহাকাশে এবং সমুদ্রের তলায় পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করতে পারবে না। ১৯৬৩ সালের এই চুক্তিটি ‘পারশিয়াল টেষ্ট ব্যান ট্রিটী’ বা ‘পি টি বি টি’ নামে পরিচিতি পায়। মানে চাইলে কোন দেশ মাটির তলায় পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করতে পারে। এই চুক্তিতে সই করে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে ফ্রান্স এবং চীন এই চুক্তি তে সই করে না। পরবর্তী কালে অবশ্য এই চুক্তির ই একটি বর্ধিত রুপ দেওয়া হয়, ১৯৯৬ সালে। যেখানে কোনরকম পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করাই নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখা হয়। চুক্তি টি কে বলা হয় ‘কম্প্রিহেনসিভ টেষ্ট ব্যান ট্রিটী’ বা ‘সি টি বি টি’ ।

লক্ষ্যনীয় যে, এই দুই চুক্তিতেই কোন দেশকে এমন বলা হয়নি যে তাদের পরমানু অস্ত্র সংক্রান্ত গবেষনা বন্ধ করে দিতে হবে। তারা শুধু পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু শুধু পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করলেই পরমানু অস্ত্র প্রসার রোধ করা সম্ভব ছিল না। তাই পরমানু অস্ত্র প্রসার রোধ করতে ১৯৬৮ সালে আর একটি চুক্তি র কথা বলা হয়। এর নাম দেওয়া হয় ‘নিউক্লিয়ার নন প্রলিফারেশন ট্রিটী’ বা ‘এন এন পি টি’ বা আরও সংক্ষেপে ‘এন পি টি’। এই চুক্তির মূল বিষয় হল বিশ্বের পাঁচটি দেশ আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন কে পরমানু শক্তিধর দেশ বলে মেনে নেওয়া হবে। এই পাঁচটি দেশ এই চুক্তিতে সই না করা অন্য কোন দেশ কে পারমানবিক প্রযুক্তি বা জ্বালানি সরাবরাহ করবে না। যে সমস্ত দেশ এই চুক্তিতে সই করবে তাদের মেনে নিতে হবে, তারা কোনভাবেই পরমানু অস্ত্র সংক্রান্ত কোনও গবেষনা করবে না। পরিবর্তে তারা পারমানবিক প্রযুক্তি বা জ্বালানি পাবে শান্তিপূর্ন পারমানবিক শক্তি (পারমানবিক বিদ্যুৎ ) উৎপন্ন করার জন্যে। কিন্তু এই সমস্ত দেশ গুলোকে নিজেদের পারমানবিক চুল্লী গুলি ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সী’ বা ‘আই এ ই এ’ র তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। যাতে ‘আই এ ই এ’ র দল দরকার হলে পরীক্ষা করতে পারে এই পারমানবিক চুল্লী গুলি শুধুই পারমানবিক বিদ্যুৎ তৈরির কাজে ব্যবহার হচ্ছে, না পরমানু অস্ত্রের জন্যে ফিসাইল মেটেরিয়াল তৈরি করা হচ্ছে। প্রসঙ্গতঃ ‘আই এ ই এ’ রাষ্ট্রসংঘের ছত্রছায়ায় কাজ করে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই ‘এন পি টি’ চুক্তিতে কোথাও এই কথা বলা নেই যে সমস্ত পারমানবিক শক্তিধর দেশগুলিকে নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে তাদের সমস্ত পারমানবিক অস্ত্রসম্ভার নষ্ট করে ফেলতে হবে। তার অর্থ এই যে, পারমানবিক শক্তিধর দেশগুলো একদিকে তাদের অস্ত্রসম্ভার রেখে দেবে, আবার অন্যদিকে, অন্য কোনো দেশকে নতুন করে পারমানবিক অস্ত্র বানাতে দেবে না। (এই প্রসঙ্গে একটি দেশের নাম এখানে উল্লেখ করতেই হয়। দক্ষিন আফ্রিকা ই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা নিজেরা পারমানবিক অস্ত্র তৈরী করেও নিজেরাই তা নষ্ট করে ফেলেছে।) চুক্তির এই খামতির কথা ভারত সহ আরও কিছু দেশ বারবার বলে এসেছে। তাই ভারতের পক্ষে এই চুক্তি সই করা সম্ভব হয় নি। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারত প্রথম পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করে ১৯৭৪ সালে। পরে আবার দ্বিতীয় পরীক্ষা করে ১৯৯৮ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন। ভারতের দ্বিতীয় পরীক্ষার পরে পরেই পাকিস্তান তাদের পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা করে। এরপরে ২০০৬ সালে উত্তর কোরিয়াও সেরে ফেলে তাদের পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা। সেই অর্থে পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা না করলেও ধরে নেওয়া হয় ইস্রায়েলের কাছেও পরমানু অস্ত্র আছে। ফলে ‘এন পি টি’ তে স্বীকৃত পাঁচ পরমানু দেশ ছাড়াও এই মুহুর্তে ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া আর ইস্রায়েল এখন পরমানু শক্তি সম্পন্ন দেশ। এর মধ্যে ভারতই প্রথম ঘোষনা করে যে তারা পারমানবিক অস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত না হলে কখনই পরমানু অস্ত্র ব্যবহার করবে না। এর মধ্যে উত্তর কোরিয়া একসময় ‘এন পি টি’ তে সই করেও পরে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে। পাকিস্তানি বিজ্ঞানী এ কিউ খান পরমানু প্রযুক্তি অন্য দেশে পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েন। আর ইস্রায়েল এখনও পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা না করায় অনেক বিশেষজ্ঞই নিশ্চিত নন তাদের সত্যিকারের ক্ষমতা কতদূর। এইরকম অবস্থায় আমেরিকা সহ ‘এন পি টি’ স্বীকৃত পাঁচ পরমানু শক্তিধর দেশ এখন ভারতকেই সবচেয়ে দায়িত্ববান পরমানু শক্তি সম্পন্ন দেশ বলে মনে করছে। তাই ভারত ‘এন পি টি’ তে সই না করলে প্রথমতঃ এই চুক্তির গুরুত্বই কমে যায়। আর দ্বিতীয়তঃ ভারতের পরমানু গবেষনার ওপরও কিছুটা নিয়ন্ত্রন রাখা যায়। ফলে ভারতকে যেনতেন প্রকারেণ ‘এন পি টি’ তে সই করাতে উঠে পড়ে লেগেছিল সমস্ত পারমানবিক শক্তিধর দেশ গুলি। কিন্তু ভারত পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দেয় এই চুক্তির দ্বিচারিতা না দূর করলে ভারতের পক্ষে এই চুক্তি সই করা সম্ভব নয়।

ভারতের আভ্যন্তরীন প্রেক্ষাপট বিচার করলে গত দশ বছরে ভারতের অর্থনীতি যেভাবে বেড়েছে তা ধরে রাখতে গেলে অন্যতম প্রয়োজনীয় হল 'বিদ্যুৎ'। ভারতে এখনও প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌছায়নি। ২০৩০ সাল অবধি বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমান হবে প্রায় দেড় লক্ষ মেগাওয়াট। ২০৫০ সাল অবধি এই ঘাটতির পরিমান বেড়ে দাড়াবে প্রায় চার লক্ষ মেগাওয়াট। কেমন করে আসবে বিদ্যুৎ, যখন তেল ভাঁড়ার প্রায় শূন্য। কয়লা যা আছে ২০৫০ সাল অবধি তা দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। অন্যান্য নন কনভেনশনাল শক্তি দিয়েও চাহিদার র সামান্য ভগ্নাংশ ও মেটানো সম্ভব নয়। পারমানবিক বিদ্যুৎ ছাড়া আর কোনও উপায় ভারতের কাছে নেই। কিন্তু পারমানবিক বিদ্যুৎ ও আমাদের সমগ্র চাহিদার প্রায় ৩-৪ শতাংশ ই বর্তমানে মেটাতে পারছে। কারন পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সমস্ত পারমানবিক চু্ল্লী গুলো ইউরেনিয়ামের অভাবে ধুঁকছে। নতুন চু্ল্লী বানানোর কথা থাকলেও কি দিয়ে চলবে সেগুলো ? এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভারত চিন্তা করতে শুরু করে ইউরেনিয়াম অন্য কোনো দেশ থেকে কিনে এনে আরও বেশী পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব কিনা।

এদিকে ভারতের প্রথম পরমানু অস্ত্র পরীক্ষার পরই তৈরী হয়েছে ‘নিউক্লিয়ার সাপ্লাই গ্রুপ’ বা ‘এন এস জি’। মূলতঃ ভারতের পরমানু অস্ত্র পরীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতেই তৈরী হয়েছিল এই সংস্থা। বলা হয়েছিল ভারত কে অন্য দেশ (কানাডা), যে পারমানবিক চুল্লী দিয়েছে শান্তিপূর্ন শক্তির প্রসারের জন্যে, ভারত তা ব্যবহার করেছে পারমানবিক অস্ত্র তৈরীর কাজে। এই রকম ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে না ঘটে, তা আটকানোর জন্যেই তৈরী হয় এই ‘এন এস জি’। যে সমস্ত দেশ, ইউরেনিয়াম অন্য কোনো দেশ কে বিক্রী করতে চায়, তাদের নিয়ে তৈরী করা হয় এই গ্রুপ। যে সমস্ত দেশ, ‘এন এস জি’ র সদস্য কোনো দেশ থেকে ইউরেনিয়াম কিনতে চায়, সেই সমস্ত দেশ কে তাদের পারমানবিক চুল্লী ‘আই এ ই এ’ র তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে।

তার মানে সোজা সরল ভাষায়:

১) এই মুহুর্তে ভারত যে অবস্থায় রয়েছে তাতে নিজেদের পারমানবিক গবেষণার জন্যেই ভারতের দরকার প্রচুর পরিমান ইউরেনিয়াম। বোঝাই যাচ্ছে যে সেক্ষেত্রে পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তা কতটা প্রয়োজনীয়।

২) ভারত কে ইউরেনিয়াম যদি কিনতেই হয় তবে সেটা অবশ্যই কিনতে হবে ‘এন এস জি’ র সদস্য এমন কোনও দেশ থেকে ।

৩) কিন্তু তাতে মুশকিল হল যে, ‘এন এস জি’ র সদস্য এমন দেশ থেকে ইউরেনিয়াম কিনতে হলে ভারতকেও সমস্ত পারমানবিক চুল্লী ‘আই এ ই এ’ র কাছে খুলে দিতে হবে। যা ভারত করতে দিতে পারে না, কারন প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তানের কাছে পরমানু অস্ত্র থাকার দরুন ভারতের কাছেও পারমানবিক অস্ত্র বানানোর জন্যে পর্যাপ্ত ফিসাইল মেটেরিয়াল থাকা আবশ্যিক, যা ‘আই এ ই এ’ কখনওই ভারতকে করতে দেবে না।

ঠিক এই সময়েই আসে আমেরিকা র সাথে একটা অন্য রকম চুক্তির সুযোগ। কেমন হয় যদি এমন একটা চুক্তি হয় যাতে ভারত আমেরিকা থেকে পাবে ইউরেনিয়াম বা অন্যান্য পারমানবিক সরঞ্জাম (ডুয়াল ইউস টেকনোলজি)। কিন্তু অধিকার থাকবে নিজস্ব ফিসাইল মেটেরিয়াল বানানোর। এই রকম একটি চুক্তিই এখন বর্তমান রাজনীতির মূল বিষয়বস্তু। চুক্তিটির নাম হল ইন্দো আমেরিকা ১২৩ চুক্তি। এতে বলা হল, ভারত তার ইচ্ছেমতো পারমানবিক চুল্লী গুলোকে সিভিলিয়ান এবং মিলিটারি, এই হিসেবে আলাদা করে দিক। সিভিলিয়ান পারমানবিক চুল্লী গুলোর জন্য ইউরেনিয়াম সরাবরাহ করবে আমেরিকা। সেই চুল্লীগুলো অব্শ্যই থাকবে ‘আই এ ই এ’ র তত্ত্বাবধানে। কিন্তু মিলিটারি পারমানবিক চুল্লীতে ভারত তার ইচ্ছেমতো ফিসাইল মেটেরিয়াল তৈরি করতে পারবে। বলাই বাহুল্য, মিলিটারি পারমানবিক চুল্লীর জন্য ইউরেনিয়াম ভারতকেই জোগাড় করতে হবে।

তাহলে ব্যাপারটা দাড়াল এই রকম যে ‘এন পি টি’ তে বা ‘সি টি বি টি’ তে সই না করেই ভারত পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইউরেনিয়াম পেতে পারে এই চুক্তির মাধ্যমে।

কিন্তু তাহলে কেন চুক্তির এত বিরোধীতা ?

তার একটা কারন হল, ভারতের সাথে এই চুক্তি করার আগে আমেরিকা তাদের দেশে একটা আইন বানিয়েছে, এই চুক্তিকে গ্রহনযোগ্য করে তোলার জন্য। প্রনয়ন কর্তা হেনরি হাইডের নাম অনুসারে এই আইনের নাম ‘হাইড অ্যাক্ট’। এই আইনের মূল বক্তব্য ভারত যদি পরমানু পরীক্ষা করে, তাহলে আমেরিকা ভারতকে আর কোনো পরমানু প্রযুক্তি বা জ্বালানি সরাবরাহ করবে না। এছাড়াও আছে আরও কিছু শর্ত, যেমন,পারমানবিক চুল্লী তে ব্যবহৃত জ্বালানি ভারত যথেচ্ছ ভাবে রি-প্রসেস করতে পারবে না। প্রসঙ্গতঃ ব্যবহৃত জ্বালানি থেকে রি-প্রসেস করে ফিসাইল মেটেরিয়াল (পরমানু অস্ত্রের জন্য ব্যবহারের উপযোগী) বের করে নেওয়া যায়।

কিন্তু তাহলে তো ভারতের প্রধান শর্ত ই পালিত হচ্ছে না। ওদের এই আইন অনুযায়ী ভারত পরমানু পরীক্ষা করার অধিকার হারাচ্ছে। তাহলে ‘এন পি টি’ তে বা ‘সি টি বি টি’ র সাথে কি তফাৎ রইল এই চুক্তির ?

আপাত দৃষ্টিতে এরকম মনে হলেও ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ এরকম নয়। কারন, ভারত ‘হাইড অ্যাক্ট’ মানতে বাধ্য নয়। ‘হাইড অ্যাক্ট’ একটি আমেরিকান আইন, যা মেনে চলার দায়িত্ব শুধু আমেরিকান সরকারের। ভারত শুধু ১২৩ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি মেনে চলার জন্য দায়বদ্ধ। যে কোনও সময় যে কোনও এক পক্ষ এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

কিন্তু প্রশ্ন হল আমেরিকা যদি সত্যিই জ্বালানি দেওয়া বন্ধ (সেটা যে কোনও কারণেই করতে পারে আমেরিকা) করে দেয়, তাহলে কি করবে ভারত?

তার জন্য অন্য রাস্তাও আছে। এই চুক্তি বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার আগে ভারতকে ‘আই এ ই এ’ র সাথে চুক্তি করতে হবে এবং তারপরে ‘এন এস জি’ র অনুমোদন নিতে হবে। এক্ষেত্রে এটা বলে নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন মনে করছি যে আমেরিকার সাথে এই ‘ইন্দো আমেরিকা ১২৩’ চুক্তি সম্পন্ন হলে ভারতকে ‘এন এস জি’ র অনুমোদন নেবার সময় শুধু মাত্র সেই সব পারমানবিক চুল্লী গুলোকেই ‘আই এ ই এ’ র কাছে খুলে দিতে হবে, যেই চুল্লী গুলো কে তারা ‘সিভিলিয়ন’ ঘোষনা করবে। যেটা ‘আই এ ই এ’ র সাথে চুক্তির সময়ই ঠিক করে নিতে পারে ভারত।

‘আই এ ই এ’ র সাথে চুক্তির সময় ভারত এমন শর্ত রাখতে পারে যাতে করে হঠাৎ করে অন্য দেশ জ্বালানি বন্ধ না করে দিতে পারে। অথবা এমন শর্ত রাখা যেতে পারে যে ভারত তার ইচ্ছে মতো জ্বালানি ভান্ডার তৈরি করে নিতে পারে, আগে থেকেই এমন বিপদের আশংকা করে, যাতে করে হঠাৎ জ্বালানি বন্ধ হয়ে গেলেও ভারতকে সমস্যায় পরতে না হয়। তাছাড়া একবার ‘এন এস জি’ র থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়ে গেলে অন্য কোনও দেশের কাছ থেকেও জ্বালানি বা প্রযুক্তি নেওয়ার ব্যাপারে কোনো বাধা থাকছে না। ফ্রান্স ও রাশিয়া ইতিমধ্যেই আগ্রহ দেখিয়েছে ভারতের সাথে চুক্তি করার ব্যাপারে। সুতরাং ১২৩ চুক্তির মতই জরুরি বিষয় ‘আই এ ই এ’ র সাথে ভারত কি শর্তে চুক্তি করছে সেইটা। ভারত সরকার ইতিমধ্যেই ‘আই এ ই এ’ র সাথে চুক্তির খসড়া প্রকাশ করেছে। তাতে উপরোক্ত শর্ত গুলিও আলোচনায় থাকছে। এই প্রসঙ্গে বলা ভাল, এই সব জটিল প্রশ্ন তখনই আসবে যখন ভারত পরমানু পরীক্ষা করতে চাইবে। বিশেষজ্ঞদের মতে অদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনা খুবই কম। এই মুহুর্তে স্বীকৃত পরমানু শক্তিধর দেশ গুলিও পরমানু পরীক্ষা একরকম বন্ধই রেখেছে, যদিও পরমানু অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ফিসাইল মেটেরিয়াল হয়ত বানিয়েই চলেছে। ভারতের মত দায়িত্ববান পরমানু শক্তিধর দেশও সেই পথেই হাঁটবে কিনা সে তো সময়ই বলবে।

পরিশেষে একনজরে দেখা যাক, এই চুক্তির ফলে ভারত কি কি পেতে চলেছে।

১) ভারত পেতে চলেছে, পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পরমানু জ্বালানি ও প্রযুক্তি। ‘এন পি টি’ তে বা ‘সি টি বি টি’ তে সই না করেই।

২) ভারতের অধিকার থাকছে পরমানু অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ফিসাইল মেটেরিয়াল বানানোর।

৩) ভারত আরও যা পাচ্ছে তা হল বকলমে পরমানু শক্তিধর দেশের স্বীকৃতি। ভারতকে গোটা বিশ্ব যে দায়িত্ববান পরমানু শক্তিধর দেশ বলে মনে করে তার প্রমান হল, শুধু ভারতের জন্যই এমন এক চুক্তি করা যা পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া বা ইস্রায়েলের মত পরমানু শক্তি সম্পন্ন দেশের পক্ষেও ঈর্ষনীয়।

৪) ভারত পরমানু পরীক্ষার অধিকারও হারাচ্ছে না। আস্থা ভোটের জবাবী ভাষনে প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহের কিছু উদ্ধৃতি এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। উনি বলেছেন,

“I confirm that there is nothing in these agreements which prevents us from further nuclear tests if warranted by our national security concerns. All that we are committed to is a voluntary moratorium on further testing. Thus the nuclear agreements will not in any way affect our strategic autonomy. The cooperation that the international community is now willing to extend to us for trade in nuclear materials, technologies and equipment for civilian use will be available to us without signing the NPT or the CTBT.”

লেখার শেষে কিছু স্বীকারোক্তি। আমি পরমানু বিশেষজ্ঞ নই, জানার তাগিদে ইন্টারনেট ঘেঁটে লেখার চেষ্টা করেছি। আমার husband (তিনি একজন নিউক্লিয়র সাইন্টিস্ট)র সাথে এই ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনা পরমানু চুক্তি বিষয়ে আমার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। তা সত্বেও এই লেখায় অনিচ্ছাকৃত কিছু ভুল থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট



সুপর্না মিত্র
২৪শে জুলাই
প্যারিস, ফ্রান্স।

8 comments:

Sharmila Dasgupta said...

khub informative ... ebar shobkichhu porishkar holo...

Anonymous said...

Suparna, tomake thanks janai- je eto complicated ekta byapar er eto shohoj byakhya korey diley. Khub sposhto lekhata. Ei topic ta discuss korar bhoy e aneke palaay! Ebar na- aar na :)

Anonymous said...

eto porishkar kore guchiye likhecho,bujhtei parchi er pechone tomar nishtha r shrom....
anek proshner uttor pelam....
bhalo laglo.

শারদীয়া পুস্পাঞ্জলি said...

Erokom ekta guruttwopurno bishoy, jeta anekei amra thik bujhte pari ni bhalo kore. Tomar research ar valuable ei article anek proshneri shohoj uttor dilo.

Shraddha.

moumitachowdhury said...

bhishon porikar kore lekha ekta somosamoyik jotil bishoy!

jhum said...

didi kagoje sarakkhon ctbt ba poromanu chuktir kotha portam kintu beparta ki adou bujhe uthte partam na valo kore. tomar lekha ta pore beparta khub valo kore poriskar holo asole ei chukti ta thik ki? khub soja kore tumi likhe bujhiyecho.

Unknown said...

suporna tumi khub sohoj o sabolil bhasai ei gurutwapurno baparta alochona korechho.amar kachhe onek kichhu poriskar holo ja etodin dhoa dhoa chhilo.

Anonymous said...

Who knows where to download XRumer 5.0 Palladium?
Help, please. All recommend this program to effectively advertise on the Internet, this is the best program!